কেন রাতভর মদ খেয়ে মাতলামি করতে হবে?
জব্বার হোসেন:
আজকাল পার্টিতে লোকে আমাকে ডাকে কম, বিশেষ করে পানাহারের পার্টি। পার্টিতে যারা পান করে না, তাদের প্রতি লোকের আগ্রহ কম থাকে। পানাহারের পার্টিতে, লক্ষ্য করে দেখেছি, আহার গৌণ, পানই মুখ্য। অনেক দিনপর, সেদিন এক পার্টিতে গিয়েছিলাম। বুমবুমবুমবুমবুম পার্টি। কেউ ভদকা নিচ্ছে, কেউ হুইস্কি, কেউ জিন। কেউবা ককটেল বানিয়ে নিয়েছে। এক সিনিয়র ভদ্রলোক তো বলেই বসলেন, ইয়ংম্যান, তোমাকে দেখে অত স্মার্ট মনে হয়, অথচ তুমি কিছুই নিচ্ছো না। বলতে বলতেই ভদ্রলোক দু’তিন শট টাকিলা শেষ করলেন। আমি যে কখনো পান করিনি তা কিন্তু নয়। হয়তো সিঙ্গেল পেগ নিয়ে তাতে বেশি করে জল ঢেলে দিব্যি আড্ডা দিয়েছি। আসলে জলটুকু আমার, আর পেগটুকু অন্যদের মন ও মান রাখতে। কেন জানি, পানের প্রতি আমার বাড়তি কৌতুহল ও আগ্রহ কখনোই ছিল না, এখনো নেই। এমন নয় যে, কোন না কোন ছুতোয়, উপলক্ষে পান করতেই হবে, মদ খেতেই হবে আমাকে।
২.
৩১ ডিসেম্বর। থার্টি ফাস্ট নাইট। সে রাতে মদ খেতেই হবে, যে কোন মূল্যে। তা নয় তো মানসম্মান ধুলোয় লুটাবে। এমনও দেখেছি পাড়া মহল্লায়, চাঁদা তুলে মদ খাওয়ার আয়োজন করা হচ্ছে। কেন পানশালা বন্ধ, কেন সন্ধ্যেয় বাড়ি ফিরতে বলা হলো, তা নিয়ে কিছু লোকের আপত্তির শেষ নেই। মদ না খেলে বর্ষবরণ হবে না কেন, আমি বুঝি না! কেন ধার করে, অন্যের কাছ থেকে চেয়ে নিয়েও মদ খেতে হবে বর্ষবরণে। থার্টি ফাস্টের কদিন আগে থেকেই, বেশ ক’জন বন্ধুর ফোন। এখানে পার্টি, সেখানে পার্টি। আমার বেশ ক’বন্ধুতো ফ্লাইটে চেপে ঢাকার বাইরে থেকে চলে এলো, ঢাকার পার্টি মিস করবে না বলে।
মদ না খেয়ে কেন বছর শুরু করা যাবে না? কেন রাতভর মদ খেয়ে মাতলামি করতে হবে, পাগলামী করতে হবে আমাকে? কেন ডিজে আর ডিসকোর নামে অশ্লীলতাকে, অনুমোদন করতে হবে? কেন দেখতে হবে আধনোংটো মেয়েদের নর্দন কুর্দন? বেলা গড়িয়ে দুপুর করে উঠে কেন শুরু করতে হবে দিন? তা নইলে আমি আধুনিক নই, সেকেলে! ক্লাব, পার্টি, ডিসকো, রক, ডিজে না হলে, আমি ব্যাকডেইটেড!
৩.
পুরুষেরা মদ্যপান, ধূমপান করছে। নারীদেরও করতে হবে? আচ্ছা পুরুষের বাজে অভ্যেস, বদস্বভাবগুলো রপ্ত করা কী নারীবাদ? বেশ কিছু তথাকথিত নারীবাদীদের জানি, যাদের ধারণা, মদসিগারেট, নারীবাদের অংশ। এতে নারীরা পুরুষের সমকক্ষ হয়ে উঠে। পুরুষের বদগুনগুলো আয়ত্ত্ব করা কেন নারীবাদ, কিভাবে নারীবাদ তা অবশ্য আমার জানা নেই। পুরুষের সমকক্ষ হয়ে উঠবার যে ধারণা, কিংবা পুরুষ শ্রেষ্ঠ এই ‘ধারণাটি’ মগজে রাখা আদৌ কোন নারীবাদ কিনা সেটাই বড় প্রশ্ন আমার। নারীবাদের উচ্চতা কি পুরুষ পর্যন্ত? সেদিন এক বন্ধু, খুব স্মার্ট বলে এক মেয়ের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিল। জানলাম, সে ছেলেদের মতোই টাকিলার শট নেয়। সিগারেট খায়। মেয়েটি দেখতে সুন্দরী, স্বল্পবসনা। বন্ধুর স্মার্টনেসের সংজ্ঞায় রীতিমত বিস্মিত হবার উপক্রম আমার। স্মার্টনেস যে জ্ঞানে, মেধায়, প্রত্যুৎপন্নমতিতায় কে বোঝাবে এদের? মদসিগারেটে আর যাই থাকুক, কোন স্মার্টনেস নেই, এইটুকু বোঝা উচিত সবারই।
৪.
অনেকেই বলেন, ক্রিয়েটিভ লোক মদ খাবে না, তা কি করে হয়? মদ না খেলে ভালো লেখালেখিও সম্ভব নয়- এমনও মন্তব্য করতে শুনি অনেককে। তাই অনেকের ধারণা, লেখক সাহিত্যিক শিল্পী মাত্রই মদ খাবেন, মদ্যপ হবেন। শুধু লেখালেখি কেন, কোন সৃজনশীলতার সঙ্গেই মদ খাওয়া, না খাওয়ার সম্পর্ক নেই। সৃজনশীলতা সবার মধ্যে থাকে না, মেধা প্রতিভা যার যার ব্যাপার। যদি তাই হতো, তবে তো কতশত মদ্যপ, মাতালের সৃজনশীলতায় জগত ভরে যেত, তা কী হয়, তা নিশ্চয়ই নয়। যে মানুষ পেগে পর পেগ, গ্লাসের পর গ্লাস মদ গেলে, মাতাল হয়, সে তো নিজের মধ্যেই থাকে না। তার চিন্তা কাজ করে না। যার চিন্তা কাজ করে না, বিকল হয়ে থাকে, সে কি করে সৃজনশীল চিন্তা করবে। আগে তো সুস্থ মস্তিষ্ক, স্বাভাবিকতা, তারপর সৃজনশীলতা। আমার খুব কাছের দুজন সৃজনশীল মানুষ, একই সঙ্গে বন্ধু এবং ভাই। তুষার আব্দুল্লাহ এবং আব্দুন নূর তুষার। দু’জনই সৃজনশীলতায়, বহুমাত্রিক জ্যোতির্ময়। দু’জনই মদ্যপান বিরোধী। দুজনের কাউকেই জীবনে কখনো মদ ছুতে দেখিনি। কোথায়, তাদের সৃজনশীলতা, সৃষ্টিশীলতা প্রমাণে মদ না খাওয়া তো কোন বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি। ব্যক্তিগত উদাহরণ এমন অনেক আছে, দেবার মতো।
৫.
ধর্ম মানুষকে শৃঙ্খলায় আনতে চেয়েছে। চেয়েছে সুশৃঙ্খল পথে পরিচালিত করতে। মদ্যপানে নিষেধাজ্ঞা সে কারণেই। আমার নিজের ধর্মের কথা জানি, বলা হয়েছে ‘অবশ্যই মদ, জুয়া ও ভাগ্য নির্ণয়ক শর নিক্ষেপ, শয়তানের কাজ।’ (সুরা আল-মায়েদাহ)। আরবে গোত্রের সঙ্গে গোত্রের বিবাদ, ফ্যাসাদ লেগেই থাকতো। একে অন্যকে আক্রমণ করা, সম্পদ লুণ্ঠন, নারীদের যখন তখন যৌন হেনস্তা, ধর্ষণ ছিল খুব স্বাভাবিক ব্যাপার। মদ খেয়ে মাতাল হয়ে এই পশুত্বের মাত্রা, অশ্লীল আক্রমণ যেত আরো বেড়ে। কেননা মদ্যপান সচেতনতাকে নষ্ট করে, অবচেতন করে বুদ্ধি বিবেক। ফলে বিবেক শূন্য হয়ে মানুষের পক্ষে যে কোন কাজই সম্ভব। তাই মদ খেয়ে কোন সিদ্ধান্ত বা কাজ না করাই ভালো। ধর্মের বারণটি সে কারণেই।
৬.
মাতাল বা ড্রাঙ্ক শব্দটি পৃথিবীর যে ভাষাতেই অনুদিত হোক না কেন, নেতিবাচক সর্বত্রই। অনেকের ধারণা, পশ্চিম বোধ হয় মদ খাওয়া, মাতলামি করাকে খুব অনুমোদন করে, মোটেও তা নয় কিন্তু। নির্দিষ্ট একটি বয়সের নিচে সেখানেও মদ গ্রহণযোগ্য নয়। আমেরিকাতে ২১ বছরের নিচে কেউ বারে যাওয়ার অনুমতি পায় না। মদ খেয়ে মাতাল হওয়া পশ্চিমেও বিবেচিত- অসভ্যতা হিসেবেই। এবারের থার্টি ফাস্ট নাইটেও আমেরিকার টেলিভিশন, অনলাইন, খবরের কাগজে বারবার প্রচারিত হয়েছে- মদ খেয়ে নিজে ড্রাইভ করবেন না, ট্যাক্সিতে বাড়ি ফিরুন। মদ খেয়ে মাতাল হয়ে, হাই স্প্রিডে গাড়ি চালানোকে এ শহরে অনেকে মনে করে স্মার্টনেস, মর্ডানিটি।
জীবন ঘনিষ্ট না হলে, সংস্কৃতি বিচ্ছিন্ন হলে, হঠাৎ করে সহজ উপার্জনের পথ পেলে এমন বিচ্যুতি ও বিকৃতি হওয়াই স্বাভাবিক। মদ এদেশের সংস্কৃতিও নয়। যারা ভাবে মদ্যপান আধুনিকতা, তারা আসলে মূর্খতাই বহন করে। মর্ডানিটি বা আধুনিকতা পোশাকে, প্রসাধনে, গাড়ি কিংবা সেলফোনের ব্র্যান্ডে নয়। থাকে মগজে, চিন্তায়, শিক্ষায়, মানবিকতায়, বিজ্ঞানমনস্কতায়, যুক্তিবাদে, উন্নত জীবনবোধের গভীরতায়। মদ খেয়ে নয়, আসুন মদ না খেয়ে বুঁদ হয়ে জীবনকে উপভোগ করি। জীবনের নেশায় ছুটে চলি।
লেখক: সম্পাদক, আজ সারাবেলা। ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক, মিডিয়াওয়াচ। পরিচালক, বাংলাদেশ সেন্টার ফর ডেভেলপমেন্ট জার্নালিজম অ্যান্ড কমিউনিকেশন। সদস্য, ফেমিনিস্ট ডটকম, যুক্তরাষ্ট্র।